মাগুরা প্রতিনিধি: মাগুরা আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি এখন যেন দুর্নীতির নতুন নাম। মাঠ পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান গবেষণা কার্যক্রম না থাকলেও প্রতিবছর বরাদ্দ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সেই অর্থে নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা। স্থানীয় কৃষক ও সুধী সমাজের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি টাকায় চলছে, অথচ বাস্তবতার মাটিতে এর কোনো অবদান নেই।
বহিরাগতদের এনে তাদের কাছে সরকারী জায়গায় বাসা ভাড়া দেয়া হয়েছে অথচ গবেষণা মাঠ ফাঁকা।সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৮টি বাসা বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই ভাড়া সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে অন্যভাবে ব্যয় হচ্ছে বলেই স্থানীয়দের অভিযোগ। অথচ মাঠ পর্যায়ের মূল গবেষণা কার্যক্রমে নেই কোনো গতি গাছ নেই,ফসল নেই,কার্যত ফাঁকা মাঠেই চলছে মসলা গবেষণা।
২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গবেষণার খাতে বরাদ্দ, ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ,বাউন্ডারি নির্মাণ,যন্ত্রপাতি, জ্বালানি, সার ও মাটির খরচ–সব খাতেই বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও এসব বিষয়ে লিখিত বা মৌখিক কোনো তথ্য দিতে নারাজ কর্মকর্তারা।
১৬ ই জুন কয়েক জাতীয় দৈনিকের কয়েকজন প্রতিবেদক তথ্য নিতে গেলে সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাঁদের মোবাইল ফোন জব্দ করে রাখেন এবং ভয়ভীতি দেখান। মৌসুমী ফল ও মাছ বিক্রি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ এবং ভুয়া বিল-ভাউচারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কর্মকর্তারা মুখ বন্ধ রাখেন।
ঈদের ছুটির সময় অফিস চত্বরে উৎপাদিত আম ও কাঁঠাল গোপনে বিক্রির সময় স্থানীয়রা হাতে-নাতে ধরে ফেলেন দুইজন কর্মচারীকে। পরে বিষয়টি সেনাবাহিনীকে জানানো হলে তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে চুরির মালামাল জব্দ করে। এ ঘটনায় জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
প্রতিবছর মাটি ও সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের নামে ব্যয় হয় লাখ লাখ টাকা। অথচ মাঠে নেই কোনো বাস্তব গবেষণার চিহ্ন। স্থানীয় কৃষকদের দাবি, এসব বরাদ্দ লোক দেখানো কয়েকটি গাছপালার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলাফলহীন এসব খাতে নিয়মিত অর্থ লোপাট হচ্ছে বলেই দাবি তাঁদের।
দীর্ঘদিন এক স্থানে কর্মকর্তা, প্রভাব ও প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান।অগ্নিকুমার সিকদার নামে এক বৈজ্ঞানিক সহকারী ১৯৯৬ সাল থেকে একটানা একই দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, প্রভাব বিস্তার, এবং অনিয়মের অভিযোগ। একই অফিসে দীর্ঘদিন ধরে আছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল ইসলাম। তাকেও কেন্দ্রের নানা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা।
কর্মচারীদের দাপট, কর্তৃপক্ষের নীরবতা চলছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ জন কর্মকর্তা, ১৬ জন নিয়মিত কর্মচারী, ১৯ জন অনিয়মিত, ১৫ জন চুক্তিভিত্তিক এবং ১৩ জন মৌসুমী শ্রমিক কাজ করছেন। কিন্তু শৃঙ্খলা নেই। অধঃস্তন কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষকে হুমকি ধামকি ও অশালীন ভাষায় কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ‘সেইন অফ কমান্ড’ না থাকায় প্রতিষ্ঠানে চলছে অব্যবস্থাপনা।
জয়নাল শেখ, স্থানীয় কৃষক (৪৮) বলেন,“প্রতিবছর শুনি কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, গবেষণা হয়। কিন্তু মাঠে তো কোনো ফসল দেখি না। কী গবেষণা হয়, সেটা কেউ জানে না। এই অফিস শুধু বিল-ভাউচার বানায় আর সরকারি সম্পদ বিক্রি করে খায়। কৃষকরা উপকার না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে।”
ড. মোঃ আশরাফুল আলম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন,“গবেষণা কেন্দ্রের কার্যক্রম পুরোপুরি নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। কিছু ছোটখাটো প্রশাসনিক সমস্যা থাকলেও তা আমরা দেখছি। ফল বিক্রির বিষয়টি তদন্তাধীন এবং যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরাদ্দ ও ব্যয়ের তথ্য আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করতে পারি না।”
ড. মোঃ ইকবাল হক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সহযোগী) বলেন, “প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে কৃষি গবেষণায় ভূমিকা রাখছে। কিছু ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেন্দ্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছেন। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময় সব কার্যক্রম নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে।”
মো. রিয়াজুল ইসলাম, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন,“গবেষণার বাইরের বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। বরাদ্দ ও খরচের হিসাব প্রশাসনিক বিভাগ দেখে থাকে। কিছু কিছু অভিযোগ বিভ্রান্তিকর।”
অগ্নিকুমার সিকদার, বৈজ্ঞানিক সহকারী (হিসাব বিভাগ) বলেন, “আমি ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে দায়িত্বে আছি, সব কিছুই নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। বাজেট ব্যবস্থাপনা, বিল-ভাউচারসহ সব আর্থিক লেনদেনের নিরীক্ষা প্রতিবছর হয়। কেউ যদি অভিযোগ করে থাকেন, তাহলে তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হলে আমি আইন অনুযায়ী জবাবদিহি করব।”
মাগুরা আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগগুলো তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হলে তা হবে কৃষি গবেষণার নামেই সবচেয়ে বড় বিশ্বাসভঙ্গ। এ কেন্দ্রটিকে কার্যকর করতে হলে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা এবং প্রকৃত গবেষণা কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এখনই বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।