রজিন ইসলাম রকি: বজ্রপাত একসময় শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা মনে করা হলেও এখন এটি বাংলাদেশের জন্য এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। গত ১৪ বছরে এই নীরব ঘাতক কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৪ হাজার মানুষের প্রাণ, যার মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশই কৃষক। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ব’জ্রপাতের প্রকোপ বাড়ছে এবং তা প্রাণহানির ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
মৃত্যুর পরিসংখ্যান যা ভাবায়
পরিবেশ অধিদফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ব’জ্রপাতের কারণে মারা গেছেন অন্তত ৩,৯৮০ জন। বছরে গড় মৃত্যু ২৮৫ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব মৃত্যু রেকর্ডে উঠে আসে না।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে কৃষকরাই
ব’জ্রপাতের শিকারদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিলেন। মাঠে চাষের সময় বা বৃষ্টির শুরুতে নিরাপদ আশ্রয় না পেয়ে খোলা জায়গায় থাকতেই ঘটে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে বর্ষা ও প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল থেকে জুন) এসব মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
নেত্রকোনা জেলার কৃষক আবদুল মালেক (৫৪) মারা যান ২০২৩ সালের মে মাসে, যখন তিনি মাঠে ধান কাটছিলেন। তার ছেলে বলেন, “আকাশ মেঘলা ছিল, কিন্তু হঠাৎ এত বড় শব্দ হবে বুঝিনি। আব্বা সেকেন্ডের মধ্যে পড়ে গেলেন।”
জলবায়ু পরিবর্তন ও ব’জ্রপাতের ঘনত্ব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্প ও উত্তাপ বৃদ্ধির কারণে ব’জ্রপাতের ঘনত্ব বেড়েছে। গবেষণা বলছে, প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ব’জ্রপাতের সম্ভাবনা ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, “আমাদের দেশে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে ব’জ্রপাত স্বাভাবিক, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন এটি প্রাণঘাতী দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে।”
সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা:
২০১৬ সালে সরকার ব’জ্রপাতকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে কিছু এলাকায় বজ্রনিরোধক গাছ (যেমন তালগাছ) রোপণ, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রচারে জোর দেওয়া হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্যোগগুলো এখনও পর্যাপ্ত নয়। অনেক গ্রামে এখনও বজ্রপাত-সচেতনতা বা আশ্রয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা ও তাৎক্ষণিক আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শও অনেকাংশে উপেক্ষিত।